প্রাচীনকালের শিকার

1719992833-82e991459f7d14687bd435aa41f08a3c.jpeg

দেশের তথ্য ডেস্কঃ

মানুষকে যদি কেবল জন্তু হিসাবে শরীরের গঠন দেখিয়ে বিচার করা হয়, তবে তাহাকে নিতান্তই আনাড়ি জানোয়ার বলিতে হয়। সে না পারে ঘোড়ার মতো দৌড়াইতে, না জানে ক্যাঙারুর মতো লাফাইতে; দেহের শক্তি বল, অথবা নখ দাঁত প্রভৃতি যে কোন অস্ত্রের কথা বল, সব বিষয়েই সে অন্যান্য অনেক জানোয়ারের কাছে হার মানিতে বাধ্য। অথচ এই মানুষই এখন আর সব জানোয়ারের উপর টেক্কা দিয়া এই পৃথিবীতে রাজত্ব করিতেছে। এখনকার যুগের মানুষ ত আত্মরক্ষার জন্য সহস্ররকম উপায় করিয়া রাখিয়াছে—শহর বাড়ি লোকালয় বানাইয়া সে বনের জন্তুর কাছ হইতে আশ্রয় পাইবার নানাপ্রকার ব্যবস্থাও করিয়াছে।

কিন্তু সেই আদিমকালের মানুষ, যার ঘরও ছিল না বাড়িও ছিল না—সে বন্দুক চালাইতে শিখে নাই, এমনকি তলোয়ার বল্লম পর্যন্ত বানাইতে পারিত না—সে কেমন করিয়া এতরকম হিংস্র জন্তুর সঙ্গে রেষারেষি করিয়া টিঁকিয়া রহিল, ভাবিতে আশ্চর্য লাগে।সে যুগের মানুষ পাহাড়ে জঙ্গলে ঘুরিয়া বেড়াইত। কেহ গুহাগহ্বরে, কেহ গাছের ডালে বাসা লইয়া বনের পশুর হাত হইতে আপনাকে বাঁচাইয়া রাখিত। চলিতে ফিরিতে কতরকম হিংস্র জন্তু আশেপাশে ঘুরিয়া বেড়াইত—তাহাদের কোন কোনটা এ যুগের জানোয়ারগুলির চাইতেও ভয়ানক।

যেখানেই সেই প্রাচীন মানুষের কঙ্কাল পাও—তাহারই আশেপাশে সেইসব পাথরের স্তরের মধ্যেই দেখিবে আরও কতরকম জানোয়ারের কঙ্কালচিহ্ন। এমন অবস্থায় সেকালের মানুষ যে আত্মরক্ষার জন্য দল বাঁধিতে আরম্ভ করিবে, ইহা খুবই স্বাভাবিক।সেকাল কথাটা খুবই অস্পষ্ট। প্রবীণ লোকেরা নিজেদের বাল্যকালের কথা বলিবার সময় বলেন, ‘সেকালে’ এইরূপ হইত।

কোন প্রাচীন যুগের উল্লেখ করিবার সময় ইতিহাসে বলে—’সেকালে’ এইরূপ হইত। কিন্তু যাঁহারা পৃথিবীর লুপ্ত ইতিহাস লইয়া চর্চা করেন, তাঁহাদের কাছে এ-সমস্ত নিতান্তই ‘একাল’। ইতিহাস যাহার কথা লেখে না—যে সময়ে ইতিহাস ত দূরের কথা, লিখিত ভাষারই সৃষ্টি হয় নাই, সেই কালই যথার্থ ‘সেকাল’। কত লক্ষ লক্ষ বৎসর ধরিয়া সেকালের মানুষ ক্রমাগত সংগ্রাম করিয়াছে, কে তাহার হিসাব রাখে? কবে কেমন করিয়া সে অস্ত্র গড়িতে শিখিল, কত ঝগড়া কত লড়াইয়ের মধ্যে কেমন করিয়া অল্পে অল্পে তাহার বুদ্ধি খুলিতে লাগিল তাহার একটু আধটু সাক্ষ্য যাহা পাওয়া যায়, তাহারই পরিচয় সংগ্রহ করিতে আজও কত পণ্ডিতের সারাটা জীবন কাটিয়া যায়।কত যুগের কত দেশের কতরকম মানুষ।

তাহারা পৃথিবীর কতদিকে চলাফিরা করিয়াছে, আর নদীর গর্ভে পাহাড়ের স্তরে তাহাদের চিহ্ন রাখিয়া গিয়াছে। পাহাড়ের গুহার মধ্যে বাস করিয়া যে-মানুষ কাঁচা মাংস খাইত; ভ্রূকুটি-কপাল চ্যাটাল-চোয়াল যে-মানুষ দল বাঁধিয়া নরমাংস ভোজন করিত; গাছের ডালে বাসা বাঁধিয়া যে-মানুষ আপন পরিবার লইয়া লুকাইয়া থাকিত; চারিদিকে আগুন জ্বালিয়া তাহার মধ্যে যে-মানুষ দলেবলে রাত কাটাইত; পাথরে পাথর শানাইয়া যে-মানুষ অস্ত্রেশস্ত্রে পোশাকে পরিচ্ছদে সভ্য হইয়া উঠিতেছিল; বড় বড় পাথরের স্তুপচক্র গড়িয়া যে-মানুষ না জানি কোন্‌ দেবতার পূজা করিত; তাহাদের কেহই এখন বাঁচিয়া নাই—কিন্তু তাহাদের প্রত্যেকেরই কিছু কিছু সংবাদ এই যুগের পণ্ডিতেরা তিল তিল করিয়া সংগ্রহ করিতেছেন।একবার ভাবিয়া দেখ, সেই গুহাবাসীর কথা; যাহাদের ঘরের পাশে সেকালের প্রকাণ্ড ভালুকগুলি অহরহই ঘুরিয়া বেড়াইত—প্রতিদিন চলিতে ফিরিতে যাহারা নানা জানোয়ারের প্রচণ্ড তাড়ায় ব্যতিব্যস্ত হইয়া থাকিত, অস্ত্র বলিতে পাথর ছাড়া যাহাদের আর কিছুই ছিল না, তাহারা যে নিতান্ত শখ করিয়া শিকার করিত না, তাহা সহজেই বুঝিতে পার। হয় শত্রুকে মারা না হয় শত্রুর হাতে মরা, ইহা ছাড়া তাহার কাছে আর তৃতীয় কোন পথ ছিল না। ‘ম্যামথ্‌’ বা অতিকায় হস্তীর মতো অত বড় একটা জানোয়ারকে কাবু করা অথবা গুহা-ভল্লুক প্রভৃতি সাংঘাতিক জন্তুগুলির সহিত লড়াই করা একলা মানুষের সাধ্য নয়—সুতরাং শিকার কাজটা তাহাদের দল বাঁধিয়াই করিতে হইত। এই শিকার ব্যাপারের মধ্যে মানুষের প্রধান সম্বল যেটি ছিল, সেটি অস্ত্রও নয় শস্ত্রও নয়—সেটি তার বুদ্ধি। দশ জনে মিলিয়া আগে হইতে পরামর্শ করিয়া শত্রুকে বেকায়দায় মারিবার চেষ্টাতেই মানুষের বুদ্ধিটা খুলিত ভাল।

প্রথমত যেমন-তেমন একটা পাথর পাইলেই সে মনে করিত ভারি একটা অস্ত্র পাইলাম। ক্রমে পাথর ছুঁড়িবার সঙ্গে সঙ্গে সে হয়ত লক্ষ করিয়া থাকিবে যে, হাতের কাছে ছোট পাথর না থাকিলে বড় পাথর ভাঙিয়া তাহাকে ছুঁড়িবার উপযোগী করিয়া লওয়া যায়। তারপর যখন হইতে সে বিবেচনাপূর্বক পাথর ভাঙিতে অভ্যাস কারিল তখন হইতেই ক্রমে অস্ত্র গড়িবার নানারকম কায়দা দেখা দিল—ঠ্যাঙাইবার অস্ত্র, গুঁতাইবার অস্ত্র, ছুঁড়িয়া মারিবার অস্ত্র, কোপাইয়া কাটিবার অস্ত্র, ভারি ভারি ভোঁতা অস্ত্র, পাথরে-খোদাই ধারাল অস্ত্র। যেদিন মানুষ আগুনকে কাজে লাগাইতে শিখিল, আর যেদিন সে নানারকম ধাতুর ব্যবহার শিখিল, সেইদিন মানুষের ইতিহাসে চিরস্মরণীয় দিন। সেইদিন হইতে মানুষ যথার্থরূপে বুঝিতে পারিয়াছে যে, জগতে তাহার প্রতিদ্বন্দ্বী আর কেহ নাই।

Share this post

PinIt
scroll to top